নিউজ ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রতীক্ষিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তির প্রস্তর স্থাপনের উদ্বোধন করেছেন। এর মাধ্যমে শুরু হল দেশের সবচেয়ে বড় ডুয়েলগেজ ডাবল-ট্র্যাকের রেল সেতু নির্মাণের কর্মযজ্ঞ প্রক্রিয়া। যমুনা নদীর উপর রেল সেতুটি নির্মাণ হলে ভ্যন্তরীণ আর্থ- সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখাসহ ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
প্রধানমন্ত্রী দেশের সবচেয়ে বড় এই রেলসেতু সকাল সাড়ে ১০ টায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে উদ্বোধন ঘোষণা করেন।গণভবন থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
এর মধ্য দিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় রেলসেতু নির্মাণের মহাকর্মযজ্ঞ শুরু হচ্ছে। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন উদ্বোধন করা হয় যমুনা নদীর ওপর নির্মিত দেশের সবচেয়ে বড় ও উপমহাদেশের অন্যতম প্রায় পাঁচ কিলোমিটার বঙ্গবন্ধু সেতু। শুরুতে পরিকল্পনায় না থাকলেও পরবর্তীতে এর নকশায় যোগ করা হয় রেল চলাচলের বিষয়টি।
২০০৮ সালে সেতুটিতে প্রথমবার ফাটল দেখা দেয়। এরপর থেকে এতে রেল চলাচলের গতিও কমিয়ে আনা হয়। এখন সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার গতিতে এই সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল করে। এত সব জটিলতা নিরসনে ২০১৬ সালে যমুনা নদীতে বর্তমান সেতুর পাশে উত্তরেই ৩০০ মিটার উজানে একটি বিশেষায়িত রেলসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে সরকার। ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার এ ডুয়েলগেজ এর ডাবল ট্র্যাকের সেতুটি নির্মাণ করা হবে শুধু ট্রেন চলাচলের জন্য।
এই সেতুটি নির্মাণে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা দেবে সহযোগিতা সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোর-অপারেশন এজেন্সি-জাইকা। এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। সেতুটির পূর্ব অংশ নির্মাণ করবে ওবায়শি করপোরেশন, টিওএ করপোরেশন এবং জেএফই এবং আইএইচআই এবং এসএমসিসির যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হবে পশ্চিম অংশ। সেতু দুই প্রান্তে শূন্য দশমিক ৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, শূন্য সাত দশমিক ৬৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচসহ মোট ৩০ কিলোমিটার নতুন লাইন নির্মাণ করা হবে।
বর্তমান বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুতে সিঙ্গেল লাইনের সীমাবদ্ধতায় ক্রসিংয়ের জটিলতায় সেতু পার হতে ট্রাফিক সিগন্যালেই নষ্ট হয় যাত্রা পথের বড় একটা সময়। ডাবল লাইনের নতুন সেতুটি নির্মাণ সম্পন্ন হলে ১০০ কিলোমিটার গতিতে যমুনা নদীতে ট্রেন পার হবে। আরও নিবিড় হবে রাজধানীর সঙ্গে কার্যকর ও গতিময় রেল যোগাযোগ।
রেলপথ মন্ত্রী মো: নুরুল ইসলাম সুজন বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্তে হতে উক্ত অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও জাইকার রিপ্রেজেনটেটিভ ইয়োহো হায়াকাওয়া। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজা স্বাগত বক্তব্য রাখেন। উদ্বোধন ঘোষণা শেষে দোয়া মোনাজাত করা হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্ত থেকে দোয়া মোনাজাত করান হাফেজ মাওলানা মুফতি মো. মিজানুর রহমান।
জাইকার অর্থায়নে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে ৩০০ মিটার উত্তর দিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরাল এই সেতু নির্মাণ হবে। প্রায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলসেতুটি নির্মাণ করবে জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হলেও সংশোধিত মেয়াদ ২ বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর চাপ কমার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু সেতুর ঝুঁকি হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভ’মিকা পালন করবে।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে সমান্তরালভাবে গাড়ি ও রেল চলছে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য খুবই ধীরগতিতে চলে রেল কোচ। শুধু তাই নয়, সেতুর ওপর চলাচলের আগে দুই প্রান্তেই বিরতি দিয়ে ইঞ্জিন চেক করতে হয় কোচগুলোর। বর্তমানে ওই সেতুতে অনুমোদিত গতিবেগ ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার।নতুন রেল সেতু দিয়ে দৈনিক প্রায় ৮৮টি ট্রেন চলাচল করতে পারবে। যার গতি হবে ঘন্টায় মিটারগেজ ১০০ কিলোমিটার ও ব্রডগ্রেজে ১২০ কিলোমিটার। বঙ্গবন্ধু রেল সেতুতে মিটার গেজ ও ব্রডগেজ কনটেইনার মালবাহী ট্রেন পরিচালনা করা যাবে। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হবে। সড়ক পথে যানজট নিরসনে সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ‘শেখ হাসিনার দর্শন রেলপথের উন্নয়ন’ এই দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে জাতিকে একটি যুগোপযোগী রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা উপহার দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকার। যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিব রেল সেতু নির্মাণের মাধ্যমে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে একটি ট্রেনের সেতুর পূর্ব পাশের স্টেশন থেকে পশ্চিম পাশের স্টেশনে যেতে প্রায় আধা ঘণ্টা লাগে। কিন্তু যমুনা নদীর ওপর পৃথকভাবে বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মাণ হলে সে ঝুঁকি আর থাকবে না। কমে আসবে ভ্রমণকালও। এতে যাত্রীদের সময়ের সাশ্রয় হবে। জ্বালানি খরচও কমবে রেল বিভাগের। একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গ থেকে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা সহজ হবে, কমবে পণ্য পরিবহন খরচ। যা ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। এটা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করে সরকার।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, ডুয়েলগেজ ডাবল-ট্র্যাকের এ সেতুটি হবে দেশের সবচেয়ে বড় রেলসেতু। এটি রাজধানীর সঙ্গে দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগব্যবস্থা আরো সহজ ও উন্নত করবে। এছাড়া ট্রেন শিডিউল বিপর্যয় কমাতেও এ সেতু সহায়তা করবে।
রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন তার বক্তব্যে বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবেন, তা দেশবাসীর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি বড় উপহার।